শামীম তালুকদার, নেত্রকোণা (লেখক ও সাংবাদিক) “ইচ্ছে হলেই আসতে পারো, রোয়াইল বাড়ী দূর্গেতে পুরাকীর্তি দেখে তুমি,মনটা পারো ভরিতে।” —-কবি এমদাদ খান ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে এবং গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্হিত নেত্রকোণা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে বর্তমান ময়মনসিংহ বিভাগের একটি অন্যতম জেলা।এ জেলায় মোট ১০ টি উপজেলা। জেলার কেন্দুয়া উপজেলার একটি ঐতিহাসিক স্হান হলো রোয়াইলবাড়ী। রোয়াইল বাড়ী কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩ কি: মি: দক্ষিণ -পশ্চিমে আমতলা ইউনিয়নে বেতাই নদীর তীরে অবস্হিত। এটি ‘কোটবাড়ী দূর্গ’ নামেও পরিচিত। বর্তমানে প্রাচীন রোয়াইলবাড়ী দুর্গের স্হাপনা হিসেবে ছাদ বিহীন কিছু ইমারত অবশিষ্ট রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ ধারণা করেন,এটা সম্ভবত মোঘল আমলের কোন সেনানায়কের বাসভবন প্রহরী সৌধ হয়ে থাকবে। আবার প্রত্নতত্ত্ববিদগণের মধ্যে কেউ কেউ এটিকে সুলতানী আমলের স্হাপনা বলে মনে করেন। প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ, সুলতানী আমল ও ইংরেজ আমলের প্রথম দিকেও এই স্হাপনার যথেষ্ট প্রাধান্য ছিল। আবার অনেকেই ধারণা করেন, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ এর পুত্র নছরত শাহ্ এ অঞ্চলে বসবাসের সময় দূর্গটি তৈরি বা সম্প্রসারণ করেন। পরবর্তীতে ঈশা খাঁ ও তার পরবর্তী শাসকের আমলেও দূর্গে ব্যাপক সম্প্রসারণের কাজ করা হয়। রোয়াইল বাড়ী দূর্গটির প্রারম্ভেই রয়েছে সিংহদ্বার ঢিবি যার অভ্যন্তরভাগ পূর্ব -পশ্চিমে লম্বা।দূর্গটির পশ্চিম পার্শ্বে বেতাই নদী ও অন্য তিনটি দিক পরিখা দ্বারা বেষ্টিত।একটি ইটের প্রাচীর দ্বারা দুই অংশে বিভক্ত। অংশ দুটির মধ্যে উত্তরের টি অপেক্ষাকৃত বড় এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে দ্বিতীয় বেষ্টনী প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ। দূর্গটির উত্তরাংশে রয়েছে একটি বুরুজ ঢিবি,সানবাঁধানো পুরুক ও একটি কবরস্থান। দক্ষিণাংশে রয়েছে বার দুয়ারী ঢিবি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাথর।১৯৯১-৯৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কতৃক দূর্গের অভ্যন্তরে পরীক্ষামূলক খনন কাজ পরিচালনা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬-১৭ অর্থ বছরেও দূর্গটি পুন:খনন করে পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এতে বুরুজ ঢিবিতে একটি লৌকিক ইমারতের কাঠামো এবং বার দুয়ারী ঢিবিতে মসজিদের ভূমি নকশা আবিস্কৃত হয়।পূর্ব দেয়ালে ৫ টি ও উত্তর দেয়ালে ৩ টি করে দরজা আর পশ্চিম দেয়ালে ৩ টি ভিন্নাকৃতির মেহ্রাব ছিল বলে অনুমান করা হয়। প্রতি সারিতে ৪ টি করে দুই সারিতে ৮ টি পাথরের পিলার যার কিছু অংশ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়ানো রয়েছে। দেয়ালে প্লাস্টারের কোন আলামত নেই।দেয়ালের বহিরাবরণ পোড়া মাটির অলংকৃত ও ইট দ্বারা শোভিত। এছাড়াও দূর্গের বিভিন্ন অংশে বেশ কয়েকটি ভবন বা ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এছাড়াও সুড়ঙ্গ পথ, নিয়ামত বিবির মাজার, পুকুর,ঢিবি,কবরস্থান সহ প্রাচীন স্হাপনার বেশকিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। বর্তমানে দূর্গের ধ্বংসাবশেষের পাশে এলাকাবাসীর উদ্যোগে একটি মাদ্রাসা স্হাপিত হয়। ঐতিহাসিক নিদর্শন, কারুকার্য, স্থাপত্যকীর্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে নথিভূক্ত করেন। ঐতিহাসিক এই রোয়াইল বাড়ী দূর্গ দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন।কিন্ত এর আধুনিকীকরণ তেমন কিছুই করা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি-রোয়াইলবাড়ী দূর্গ অবস্হিত এলাকাটি একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকা সত্বেও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা আর হয়ে উঠছে না।