বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫০ অপরাহ্ন
শিরোনামঃ
বিজ্ঞাপন
আপনার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিন ।  যোগাযোগঃ 01977306839

গাইবান্ধা জেলা অসহায় শিশুদের শিক্ষা দেন ১ টাকার মাস্টার

Reporter Name / ১৪০৭ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০২২, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

 

মো:সাব্বির হোসেন রনি।
গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি :ম্যাট্রিকের গণ্ডি পেরিয়ে আর্থিক ভাবে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় লুৎফর রহমানের। নিজের সেই আক্ষেপ লুকিয়ে শিক্ষার আলো ছড়ানোর শপথ নেন তিনি। সেই ১৯৭২ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের গাছতলা, আঙিনা কিংবা বাঁধের ধারে পাঠ দিচ্ছেন এই শিক্ষানুরাগী।

পাঁচ দশকের শিক্ষকতা জীবনে লুৎফর রহমান এভাবে পড়িয়েছেন ৪ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে।

লুৎফর রহমান প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে আবার কখনও সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে শিশুদের পড়ান। প্রথম দিকে পড়াতেন বিনা পারিশ্রমিকে। একসময় নাম মাত্র গুরুদক্ষিণা হিসেবে নেয়া শুরু করেন মাত্র এক টাকা। আর সেই থেকে এলাকায় তিনি পরিচিতি পান ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসেবে।

গাইবান্ধা শহর থেকে বালাসীঘাট সড়ক ধরে সাত কিলোমিটারের পথ বাগুড়িয়া গ্রামের। সেখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ধারে টিনের ঘরে বসবাস লুৎফর রহমানের। গ্রামটির ভিন্ন কোনো বিশেষত্ব না থাকলেও ‘এক টাকার মাস্টার’ লুৎফর রহমানের বদৌলতে পুরো জেলায় পরিচিতি পেয়েছে গ্রামটি

১৯৫০ সালের ৭ আগস্ট গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া গ্রামে জন্ম লুৎফর রহমানের। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। তবে সে সময় আর্থিক ভাবে কলেজে পা রাখতে পারেননি তিনি।

উড়িয়াতে থাকাকালে ৮০ বিঘা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল লুৎফরদের। কিন্তু ১৯৭৪ সালের বন্যা ও নদীভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হন তারা। পরে আশ্রয় নেন বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে। স্ত্রী লতিফুল বেগমসহ দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার তার। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লাভলু এসএসসি পাস করার পর আর্থিক ভাবে আর পড়তে পারেনি। এখন অটোরিকশা চালান তিনি। ছোট ছেলে মশিউর রহমান একটি মাদ্রাসা থেকে মাস্টার্স সমমানের (দাওরা) পাস করে বেকার রয়েছেন।

গ্রামবাসী জানান, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন লুৎফর রহমান। এরপর পায়ে হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে পথ পাড়ি দেন তিনি। পাশের বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া, মধ্যপাড়া ও পূর্বপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের শিক্ষার্থী পড়ান।

লুৎফর রহমানের লক্ষ্য প্রাথমিকে ঝরে পড়াসহ ভাঙনকবলিত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বই, খাতা, কলমসহ তাদের নিয়ে কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে কিংবা বসে পড়েন গাছতলায়। বর্তমানে তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০।

লুৎফর রহমান ২০১৯ সালের জুনে শহরের স্টেশন এলাকার জুম বাংলাদেশ স্কুলে পাঠদান শুরু করেন। সেখানেও বিনা পয়সায় পড়ানো হয় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের।

লুৎফর রহমান জানান, যমুনা নদীবেষ্টিত ওয়াপদা বাঁধের চারপাশের গ্রামগুলো বন্যাকবলিত। বেশির ভাগ মানুষ গরিব। সন্তানদের পড়াতে অনীহা দেখান অভিভাবকরা। সে জন্য নামমাত্র গুরুদক্ষিণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেখান তিনি। ১৯৭২ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর আর্থিক ভাবে তিনি কলেজের বারান্দায় পা রাখতে পারেননি। এই না পাওয়ার বেদনা ভুলতেই শিক্ষার্থী পড়ান।

তিনি আরও বলেন, ‘এসএসসি পাস করার পর সব জমাজমি নদীতে চলি গেল। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ১৯৭৪ সালের অকালের মধ্যে ছেলেরা পড়তে পারবি না। এদের শিখেলে কাজে লাগবি। কেউ জজ হবি; কেউ ম্যাজিস্ট্রেট হবি। তাদের মুখে হাসি ফুটবি।’
দুর্ভিক্ষের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তখন তো অভাব খুব। প্রথমে বিনা পয়সায় পড়াছি। পরে এক টাকা করি নিছি। এখনও যে যা দেয় তাই নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছাত্র অনেকেই ভালো ভালো জায়গায় গেছে। সরকারি ডাক্তার, প্রভাষক, কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছে। এসব মনে হলে, সব কষ্ট ভুলে যাই।’

মদনেরপাড়া গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসমিন খাতুন বলে, ‘লুৎফর স্যার অনেক আদর করে। বাড়িতে এসে পড়ায়। তার কাছে পড়তে ভালো লাগে।’

মধ্য বাগুড়িয়া সরকারি প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হোসনা বানু বলে, ‘আমি ওয়ান থেকে স্যারের কাছে পড়ি। স্যার খুব ভালো। স্যার অঙ্ক, বাংলা ও ইংরেজি সব বই পড়ায়।’

ঢুলিপাড়া গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জুয়েল মিয়া বলেন, ‘ক্লাস ওয়ান থেকে স্যারের কাছে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্যারের পড়ানোর পদ্ধতি ব্যতিক্রম। বহু সহপাঠী আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ডাক্তার-ইউএনও হয়েছে স্যারের ছাত্র।’

স্থানীয় সমাজকর্মী বদিয়াজ্জামান মিয়া বলেন, ‘আমরা বিখ্যাত কিছু দার্শনিকের নাম জানি। যেমন, প্লেটো, সক্রেটিস। তারা গ্রামগঞ্জে, হাটে-বাজারে গিয়ে মানুষদের সমাবেত করে জ্ঞান দান করতেন। ঠিক লুৎফর স্যারের পাঠদান পদ্ধতিটাও এ রকম।’

জুম বাংলাদেশ স্কুলে স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষকতা করেন যুবক মেহেদী হাসান। তিনি লুৎফর রহমানের নানা গুণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘স্যার এক টাকার বিনিময়ে দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী পড়ান। স্যারের বাড়তি আয় নেই। স্যারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাকে জুম বাংলাদেশ স্কুলে আনা হয়। এখান থেকে স্যারকে সম্মানীসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’

লুৎফর রহমানের স্ত্রী লতিফুল বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী; তিনি এক টাকার মাস্টার হিসেবে পরিচয় (পরিচিতি)। দেশের ছেলেপেলে যেন টিপসই মুক্ত হতে পারে। অশিক্ষিত যাতে না থাকে। তিনি (লুৎফর রহমান) সব সময় এটা বলে।’

গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিক্ষার আলো ছড়ানো এই ফেরিওয়ালা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সম্মাননা পদক পেয়েছেন। তার নানা সুখ্যাতির কথা তুলে ধরে তার বড় ছেলে লাভলু মিয়া বলেন, ‘আমার বাবা এক টাকার মাস্টার। এটা শুনলেই গর্ববোধ করি। আমি চাই, আব্বার বাকি জীবনটাও এভাবেই কাটুক।’

লুৎফর রহমান মাস্টার সম্পর্কে গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ ইদু বলেন, ‘লুৎফর স্যার একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। বর্তমান বাজারে এক টাকার মূল্য নেই; তবুও তিনি এতেই সন্তুষ্ট।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Design & Developed by : BD IT HOST